কথোপকথন: সিজন—১

কথোপকথন: সিজন—১

কেটলির গরম পানি দিয়ে কাঁচের গ্লাস ধুয়ে নেওয়া হলো। তাতে ঢালা হলো গরম পানি— মেশানো হলো কড়া চা-পাতার রস! বানিয়ে দেওয়া হলো দুজনের হাতে— কড়া লিকারের চা। তারা দুজন বন্ধু। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে।

ইউসুফ (চায়ে একটা চুমুক দিয়ে হুযাইফার দিকে তাকিয়ে; হালকা হেসে): যে গরম পড়তাছে রে ভাই তাতে মনে হইতাছে আল্লাহ আমাদের উপর খুব একটা সন্তুষ্ট না…

রসিকতা করে বলেছে কিনা কে জানে!
টোঙের দোকানের সামনের কাঠের বেঞ্চিতে বসে তারা চা খাচ্ছে। হুযাইফা হ্যাঁ বললেই ওরা পেছনের কফিশপটাতে বসতে পারতো। গাছ আছে বাতাস হবে বলে হুযাইফা ওকে এখানেই নিয়ে বসেছে। একটু গরম পড়লে ওরা এখানে এসে বসতো ছোট বেলায়, সচরাচর বাতাস থাকেই এখানে। কিন্তু আজকে বেজায় গরম বাতাস তো দূর-কি-বাত গাছের একটা পাতাও নড়ে না। কফিশপটা বসলেই বোধয় ভালো হতো।

প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে ওরা, ইউসুফের মা বলে— “কি যে পড়ছস তোরা কিছুই বুজি না, না নিজে চান্স পাইছস না বন্দুডারে পাইতে দিছস। ছুটিতে যে আইছস কিছু বই-খাতা কি লগে আনছস? এইযে সকাল বিকাল আল্লার নামে বাড়ি থাইকা বের হস, বাড়ি আশার আর নাম নাই।” এসব ওদের কানে এখন বেলতার একগুয়ে আওয়াজ মনে হয়। চেষ্টা তো করেছে, বাকিটা আল্লাহ যা চাই। নাকি ওদের চেষ্টা প্রাইভেট ভার্সিটি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল; আল্লাহ মালুম!

হুযাইফা (উদাস মনে): কথা খারাপ কস নাই। এই যে দেখ মুসলমানদের উপর সারা পৃথিবীতে কত নির্যাতন হইতাছে— আমরা কি আসলেই কিছু করতাছি? আল্লাহ খুশি হইবো ক্যামনে?

ইউসুফ (হামাস-ইজরাইলের প্রসঙ্গ টেনে): হ, ফিলিস্তিনে তো আর কম মানুষ মারতাছে না। ফেসবুকে দেখলাম কালকে ত্রানের খাবার নিতে গেছে আর হেরা গুলি করছে। কি-এক-অবস্থা!

হুযাইফা (আগ্রহী স্বরে): ত্রান তো ঢুকতেও দিতাছে না। এইদিকে মানবতার ঠিকাদার জাতিসংঘ সভা ডাকে আর স্থগিত করে, মুনাফেকরাও এর থেকে ভালো মনেহয়…

একটু দূরেই কয়েকজন এলাকাবাসী টুল নিয়ে বসে আছেন। দূরে বললে ভুল হবে— ওদের কথা শোনা যাচ্ছে এরকম দূরত্ব। তারা এই মিশ্রভাষীদের আলেচনায় কান পেতেছেন। মাঝেমাঝে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন।

ইউসুফ (তাচ্ছিল্য করে): জাতিসংঘের কথা তো বাদই দিলাম, সৌদি আরব যেভাবে ট্রাম্পকে বরণ করলো বাপরে-বাপ— এর থেকে তো ইরানই ভালো আছে। দু-একটা হামলা-টামলা করতাছে।

হুযাইফা (চায়ে চুমুক দিয়ে): কালকে তো দেখলাম ইজরাইল আবার ড্রোন হামলা চালাইছে। লাভ কি হইলো? ইরান নিজের জন্য ছাড়া ইজরাইলে হামলা চালায় না। ওর ক্ষমতাও নাই— কিন্তু একটু আধিপত্য বিস্তার করতে চাই। দেখাইতে চাই সেই ইসলামের হয়ে লড়ার মতো বড় শক্তি। কিন্তু অধিকাংশ স্কলারের মতে হেরা তো মুসলমানই না।

ইউসুফ (একটু মনক্ষুন্ন হয়ে): দেখ তোর বিষয়ে আমার সবই ভালো লাগে এই এক শিয়া বিদ্বেষ ছাড়া। আজ ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের পাশে একমাত্র বাস্তব শক্তি দাঁড়াইছে-ইরান। হামাসরে ইরান রকেট, প্রযুক্তি আর আর্থিক সহায়তা তো দিতাছে।

হুযাইফা (কিভাবে বুঝাবে ভেবে বললো): তুই কি আসলেই জানস কিছু? ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ রক্ষা করতে চাইতাছে, যেখানে হামাসকে সে দেখতাছে তার একটা পছন্দের ষড়যন্ত্রমূলক বাহিনী (ইরানের ধারণা মতে) হিসাবে। কারণ এইটা ইরানের ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী করার একটা সুযোগ হইতে পারে। যেরকমটা পাকিস্তানের আইএসআই তালেবানকে দিয়ে করাতে চাইছিল। কিন্তু মোল্লা ওমর একরেখা নেতা আছিলেন দেইখা পারে নাই। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত হামাসের যুদ্ধকে বিতর্কিত করার কোনো সুযোগ নাই কিন্তু! তাদের যখন সাহায্য দরকার হলে প্রথমে মুসলিম দেশগুলোর দিকেই তাকাইব। যখন এরা দিব না তখন অন্যদের থাইকাই লইব, এইটা স্বাভাবিক। কিন্তু তোর-আমার আর হামাসের মধ্যে মূল পার্থক্য হইল হেরা জানে ইরান কোন স্বার্থে সাহায্য করতে চাই তার তুই আমি জানি না। তাই ইরানে হামলা হইলেও সেটার জবাবে হামাস হামলা করে না, আবার ফিলিস্তিনে হইলেও ইরান করে না। কারণ সম্পর্কা শুধুই রাজনৈতিক আর ব্যবসায়িক। এখন তুই কি ঈমান বেঁইচা ইরানরে সাপোর্ট করবি?

ইউসুফ (হালকা হেসে): এই কথাডা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়। মূল প্রশ্ন হইলো, আজ মুসলিম শিশুদের মাথায় বোমা বর্ষণ করছে কে? ইসরায়েল। আর ইরানই একমাত্র রাষ্ট্র যারা প্রক্সি ফোর্সের মাধ্যমে তাদের থামাতে চায়— হিজবুল্লাহ, হাউথি রেজিস্ট্যান্স…

চা শেষ দুজনেরই। আরেক কাপ অডার্র করেছে। চা হতে নিয়ে হুজাইফা শুরু করলো।

হুযাইফা: হ্যাঁ, কিন্তু সেই “প্রক্সি যুদ্ধ” কি খাঁটি নিয়্যতের জন্য? তুই কি জানোস, ২০০১ সালে ইরান তালেবানের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে গোয়েন্দা তথ্য দিছিল (NY Times, 2001)? ইরান Northern Alliance—কে অস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে সাহায্য করেছিল (NY Times, 2001)। আগের কথা তো বাদই দিলাম, একবার খামেনেই নিজেই কইছিল, “আহলে সুন্নাহর আকিদা শিরকপ্রসূত (MEMRI, 2016)। যে তোর-আমার রাসূলের আকিদারে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাইলে কোন দিক থাইকা এরা তোর-আমার ভালো চাইব? ২০২১ তালেবান বিজয়ের পর আমেরিকা আর ইরান হাজার সুন্নিকে গ্রেফতার করছিল (Human Rights Watch)।

ইউসুফ (গরম চায়ের ঢোক গিলে): তা ঠিক। তবে সেই সময় তালেবান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পাইছিল না। রাজনীতিতে সময় ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হইব, এ্যামনে-এ্যামনে রাজনীতি হয় না। আর ইমাম গাজ্জালী কি কইছিল মনে আছে? “যে শক্তি কাফির শক্তিকে দুর্বল করে, তা অস্থায়ীভাবে সমর্থনযোগ্য যদি তা উম্মাহর স্বার্থে হয়।” — (ফিকহুল আকবর)

হুযাইফা (সরাসরি): গাজ্জালীর ফিকহ আর ইবনে তাইমিয়্যার ফাতওয়া তো পরস্পরবিরোধী না। “বিদআতিদের সাথে জিহাদ ফরজ, কিন্তু তাদেরকে নেতৃত্ব দিতে দেওয়া হারাম।” — (মাজমুউল ফাতাওয়া, ২৮/৫৪৩) আর তুই যে কইছিলি ইরান মুসলিমদের রক্ষা করতাছে, তারাই তো সিরিয়া ও ইরাকে সুন্নিদের কবর বানাইছে। “শিয়া মিলিশিয়ারা হাজার হাজার সুন্নিকে গণহারে হত্যা করেছে।” — (Amnesty, 2014)

ইউসুফ (আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে): তুই আর কোনো মুসলিম দেশকে দেখা যে এই মহূর্তে ফিলিস্তিনকে সাহায্য করতাছে?

হুযাইফা (হতাশ হয়ে): ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই তো নিজেদের সাহায্য করতাছে না। ফিলিস্তিনের সব অঞ্চল তো হামাসের সাথে যুদ্ধই করেনি! আমার তো বুঝেই আসেনা এরা আল-আকসার, আল-কুদসের পরিবর্তে নিজের জীবনের প্রতি এত মায়ায় কবে পড়লো? জিহাদ তো সবার কপালে নাই। আল্লাহ যাদের এই উত্তম মৃত্যু দান করবেন তারাও তো উত্তমই হবেন। যেন-তেন মানুষ কি এই সুযোগ পাইব? কোনো মুসলিম দেশেই তো এখন খিলাফত নাই আর এমন শাসকও নাই যে সরাসরি পুরো দেশ নিয়ে জিহাদে নামব। আফগানিস্তানের হিসাব হয়তো এরকম যে হেরা জরাইলে ওপেন ওয়ালর্ড ওয়ার শুরু হইয়া যাইবো। হিসাবে অবশ্য তাই ঠেকতাছে।

ইউসুফ (উদগ্রীব হয়ে): আফগানের ব্যাপার নাহয় তোর যুক্তির খাতিরে মাইনা নিলাম। কিন্তু ইরানের সাথে সমস্যা কি? সে তো সাহায্য করতাছে মানতাছোস না কেন? আবার কোনো মাসলমান দেশ ওর মতো শক্তিশালীও হয় নাই। এত পারমানবিক (বোমা) তোর আছে? না আছে ড্রোন!

হুযাইফা: তুই তো জানোসই, “যে অস্ত্র শিশু, গাছপালা, নিরপরাধ মানুষকে ধ্বংস করে, তা ইসলামে হারাম।” — (আল—মুগনী, ইবনে কুদামা) পারমানবিকের রিয়্যাকশন জাপানরে দেখেও মনে পড়তাছে না তোর? এইডা ব্যবহার যায়েজ কিনা সেইটা ভাবলিনা একবারও আর পারমানবিক আছে কি নাই এই নিয়ে চিল্লানী? করবি কি এইটা দিয়া? যারা সম্মুখ সমরে পারে না তারা এইগুলা চালায় আধিপত্য দেখাতে। দেখো এত মানুষ মারছি! কয়টা সৈন্য তারা এভাবে মারতে পারে? হ্যাঁ ড্রোনের কথা কইতে পারস! হেইডা আমাদের নাই। নাই কইলে ভুল হইব আছে তবে আরো দরকার। কিন্তু যুদ্ধে বন্দি বানানো বেশি দরকার মানুষ মারলে তো আর তার পরি কল্পনা মারা যায় না। আর কুরআনে বলা আছে, “সে পৃথিবীতে ধ্বংস সৃষ্টি করে, ফসল ধ্বংস করে ও মানুষের রক্তপাত ঘটায়, অথচ বলে সে শান্তি আনতে চায়।” — (সূরা বাকারা: ২০৫) পারমাণবিক বোমা এই “তাফসিদ ফিল আরদ”—এর চূড়ান্ত উদাহরণ। আর ইরানের প্রযুক্তির ৮০% রাশিয়া আর চীন থাইকা আসে। এইটা “উম্মাহর স্বাধীনতা” না, বরং এক নয়া-ঔপনিবেশিক লেনদেনের দার খুলে দেয়। নিজের কিছু নাই আর মানসের জিনিসে মোড়লহীরী।

ইউসুফ: তাইলে কি কইতাছোস, ইরান তোর বন্ধু না— সাহায্য যা করে নিজের স্বার্থে করে ধরইরা নিছি। তাইলে কে এই হামাসরে বাঁচাবে? ফিলিস্তিনের যে অবস্থা কোনো মুসলিম দেশ আগায় আসে না; কে আল-আকসা দখল ঠেকাবে?

চায়ে শেষ চুমুকটা দিল ইউসুফ। এরপর কাপ হতে নিয়ে দাড়িয়ে পড়ল হুজায়ফার অপেক্ষায়।

হুযাইফা (মুচকি হেসে): আর যেইহোক অন্তত শিয়াদের দিয়ে একাজ আল্লাহ নিবেন না। আল্লাহ তো বলেই দিছেন, “আল্লাহ যদি একদল মানুষকে আরেকদল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু আল্লাহ জগতসমূহের প্রতি অতি অনুগ্রহশীল।” ( আল বাকারা ২৫১) তাই আমরা ইরানের হামলায় ইজরাইল ক্ষতিগ্রস্থ হইলে আমরা খুশি হই। আল্লার পরিকল্পনা ঘটার পরে আমরা উপভোগ করি আরকি। কিন্তু তাদের বন্ধু হিসেবে চাই না। অতীতে সুন্নি মুসলমানদেরই রক্তে হাত রঞ্জিত করছে ওরা। বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত দৃষ্টিকোণ হইতাছে “শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু”— এই কথাটাই। “আকিদা ছাড়া কেউ উম্মাহর বন্ধু নয়”— এইটাই হইতাছে মূল কথা।

“আরে রাখ— বিল আমি দিতাছি।”— এই দ্বন্দে সন্ধ্যে নামলো, মাগরিবের আজান পড়ল।

কথা তো চলবেই, তবে বলে রাখি টোঙের দোকানের চায়ের কাপের ঝড়গুলো আসলে এমনই। কাপ কখন উজাড় হয় কেউ জানেই না।

1 thought on “কথোপকথন: সিজন—১”

  1. Mubtasim Sajid Ahmed (Arian)

    MaShaAllah, well written & a much needed explanation/refutation of a common misconception in the modern ummah.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top