বিশেষ দ্রষ্টব্য: শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানার স্বার্থে নিরপেক্ষ দিক থেকে ব্লগটি লেখা হয়েছে। এরসাথে ইসলামিক বিশ্বাসের পার্থক্য রয়েছে এবং অবশ্যই ইসলাম সত্য। কাব্বালিস্টরা যেভাবে বিভিন্ন সময় তাদের এই প্রাচীন জ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ করেছেন এবং বিভিন্ন গবেষণায় এর সম্পর্কে যা বেরিয়ে এসেছে সেগুলোই এ লেখার ভিত্তি। সংক্ষিপ্ত হওয়ায় এখানে সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। এর সম্পর্কে আরো গভীর জ্ঞান পেতে হলে তথ্যসূত্রের বইগুলো পড়া যেতে পারে। আপাতত আমাদের উদ্দেশ্য কীভাবে এর ব্যবহার মুসলমান হিসেবে আমাদের ক্ষতি সাধন করছে এবং তা থেকে বাঁচার উপায় তালাশ করা— সেই বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের যতটুকু জানা প্রয়োজন তিন পর্বের এই ব্লগে ইন-শা-আল্লাহ্ সবই আমরা জানতে চেষ্টা করবো।
কাব্বালা: ইহুদি রহস্যবাদের ইতিহাস, দর্শন ও আধুনিক প্রচার
(Kabbalah: History, Philosophy, and Modern Propagation of Jewish Mysticism)
কাব্বালা (קַבָּלָה) ইহুদি ধর্মের একটি গূঢ় ও জটিল রহস্যবাদী দর্শন, যা ঈশ্বর, সৃষ্টি, এবং মানবাত্মার মধ্যকার সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে। কাব্বালাহ (קַבָּלָה) শব্দের অর্থ “প্রাপ্তি” বা “ঐতিহ্য” অথবা “গ্রহন করা” বা “মেনে নেওয়া”। এর উৎপত্তি ১২শ শতকের দক্ষিণ ইউরোপে, তবে এর বীজ প্রাচীন হিব্রু রহস্যগ্রন্থ যেমন সেফের ইয়েতজিরা (Sefer Yetzirah বা “বিশ্ব সৃষ্টির বই”) এবং হেখালট সাহিত্য (Heichalot Literature বা “প্রাসাদের সাহিত্য”)-এ পাওয়া যায়। (মধ্যযুগে, বিশেষত ১২শ ও ১৩শ শতকে স্পেন ও ফ্রান্সে কাব্বালাহর বিকাশ ঘটে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জোহর গ্রন্থ।)
প্রায় সহস্রাব্দের ইতিহাসে এটি কেবলমাত্র রাব্বি ও পণ্ডিতদের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এটি একাডেমিক গবেষণা, আধ্যাত্মিক আন্দোলন, এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। এই ব্লগে আমরা কাব্বালার উৎপত্তি, মূল ধারণা, ঐতিহাসিক বিকাশ, এবং আধুনিক যুগে এর বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
১. কাব্বালার উৎস: প্রাচীন রহস্যবাদ থেকে মধ্যযুগীয় শাস্ত্র
প্রাচীন হিব্রু রহস্যবাদের বীজ (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী – ৬ষ্ঠ শতাব্দী)
কাব্বালার শিকড় প্রোথিত রয়েছে ইহুদিদের নবী ও ধ্যানীদের গূঢ় অভিজ্ঞতায়। হিব্রু বাইবেলের কিছু অংশ, যেমন ইজেকিয়েলের রথ-দর্শন (ইজেকিয়েল ১:৪-২৮), ঈশ্বরের সিংহাসনের রহস্যময় বর্ণনা দেয়, যা পরবর্তীতে মেরকাভা (রথ) রহস্যবাদ-এর ভিত্তি হয়ে ওঠে।
হেখালট সাহিত্য (Heichalot Literature): ৩য়–৬ষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত এই গ্রন্থগুলিতে সাধকরা ধ্যানের মাধ্যমে স্বর্গীয় প্রাসারে (হেখাল) ঊর্ধ্বলোক ভ্রমণের বর্ণনা দেন। সেফের হা-রাজিম (Sefer HaRazim) গ্রন্থে ফেরেশতাদের নাম ও মন্ত্রের সংগ্রহ পাওয়া যায়।[1]

সেফের ইয়েতজিরা (Sefer Yetzirah): “বিশ্ব সৃষ্টির গ্রন্থ” নামে পরিচিত এই রচনায় হিব্রু বর্ণমালা ও সংখ্যার মাধ্যমে সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি কাব্বালার সেফিরট ধারণার প্রাথমিক উৎস।[2]

মধ্যযুগ: স্পেনে কাব্বালার স্বর্ণযুগ (১২শ–১৩শ শতাব্দী)
১২শ শতকে ইউরোপে কাব্বালা একটি সুসংহত দর্শন হিসেবে আবির্ভূত হয়।
সেফের হা-বাহির (Sefer ha-Bahir): ১১৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থে প্রথম সেফিরট (ঈশ্বরের দশটি গুণ) এবং শেখিনা (ঈশ্বরের নারী সত্তা) ধারণার বিকাশ ঘটে। এটি গিলগুল (আত্মার পুনর্জন্ম) তত্ত্বেরও সূচনা করে।[3]

জোহর (Zohar): ১৩শ শতকে স্পেনের মোসেস ডি লিওন কর্তৃক রচিত এই গ্রন্থকে কাব্বালার “বাইবেল” বলা হয়। জোহরে তোরাহের প্রতিটি শব্দকে সেফিরট ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আদমের পতনকে ঐশ্বরিক আলোর বিচ্ছুরণ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।[4]

২. দার্শনিক ভিত্তি: ঈশ্বর, সৃষ্টি ও মানবের ভূমিকা
আইন সফ (Ein Sof): অসীমের ধারণা
কাব্বালায় ঈশ্বরকে আইন সফ (“অসীম”) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে—একটি নিরাকার, অজ্ঞাত, ও সর্বব্যাপী সত্তা। বিশ্ব সৃষ্টির জন্য ঈশ্বর তজিমতজুম (Tzimtzum) বা স্বেচ্ছায় সংকোচনের মাধ্যমে নিজেকে সীমিত করেন, যার ফলে একটি শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়। এই শূন্যস্থানেই মহাবিশ্বের বিকাশ ঘটে।[5]

Metaphorical scheme of emanated spiritual worlds within the Ein Sof.
সেফিরট (Sefirot): ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ
দশটি সেফিরট হলো ঈশ্বরের গুণাবলির প্রকাশ, যা জীবন বৃক্ষ (Tree of Life) ডায়াগ্রামে চিত্রিত। প্রতিটি সেফিরা একটি অনন্য শক্তির প্রতীক:
সেফিরা | গুণ |
কেটার (Keter) | ঐশ্বরিক ইচ্ছা |
হোখমা (Chokhmah) | প্রজ্ঞা |
বিনা (Binah) | বুদ্ধি |
হেসেদ (Chesed) | দয়া |
গেভুরা (Gevurah) | ন্যায়বিচার |
টিফেরেট (Tiferet) | সৌন্দর্য |
নেটজাখ (Netzach) | স্থায়িত্ব |
হোড (Hod) | গৌরব |
ইয়েসোড (Yesod) | ভিত্তি |
মালখুত (Malkhut) | রাজত্ব |
টিক্কুন ওলাম (Tikkun Olam): বিশ্ব মেরামতির মিশন
কাব্বালায় মানুষের মূল লক্ষ্য হলো টিক্কুন ওলাম (“বিশ্ব মেরামতি”)। প্রতিটি নৈতিক কাজ, প্রার্থনা, বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ ঐশ্বরিক আলোকে পুনরুদ্ধার করে এবং বিশ্বকে তার আদি পবিত্র অবস্থায় ফিরিয়ে আনে বলে ধারণা করা হয়।[6]

৩. ঐতিহাসিক বিকাশ: সাফেদ থেকে হাসিদিবাদ
১৬শ শতক: লুরিয়ানিক কাব্বালার বিপ্লব
উসমানীয় শাসনাধীন সাফেদ শহরে (বর্তমান ইসরায়েল) ইসহাক লুরিয়া (আরী) কাব্বালাকে নতুন মাত্রা দেন। তাঁর তত্ত্বের মূল স্তম্ভ:
১. শেভিরাত হা-কেলিম (Shevirat HaKelim): ঐশ্বরিক আলো ধারণকারী আধ্যাত্মিক পাত্রগুলির ভাঙন, যার ফলে বিশ্বে অশুভতার উদ্ভব হয়।

২. টিক্কুন (Tikkun): মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ভাঙন মেরামত করা।
লুরিয়ার শিক্ষা হাসিদিবাদ ও আধুনিক ইহুদি চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে ।[7]

১৮শ শতক: হাসিদিবাদের উত্থান
পূর্ব ইউরোপে ইসরায়েল বেন এলিয়েজার (বাল শেম টভ) হাসিদিবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই—সাধারণ মানুষও প্রার্থনা, নৃত্য, ও আনন্দের মাধ্যমে দেবেকুত (ঈশ্বরের সাথে একাত্মতা) অর্জন করতে পারে।[8]

১৯শ–২০শ শতক: একাডেমিক পুনর্জাগরণ
জার্মান পণ্ডিত গেরশম শোলেম কাব্বালাকে ঐতিহাসিক-বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অধ্যয়ন করেন। তাঁর গ্রন্থ Major Trends in Jewish Mysticism (১৯৪১) আধুনিক পাঠকদের জন্য কাব্বালার দার্শনিক গভীরতা উন্মোচন করে।

৪. আধুনিক যুগে কাব্বালা: বৈশ্বিক প্রসার ও বিতর্ক
কাব্বালা সেন্টার ও সেলিব্রিটি সংস্কৃতি
১৯৯০-এর দশকে ফিলিপ বার্গ প্রতিষ্ঠিত কাব্বালা সেন্টার নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, ও লন্ডনে শাখা খোলে। ম্যাডোনা, ডেমি মুর, ও অ্যাশটন কুচারের মতো তারকারা লাল সুতো (Red String) পরিধান এবং “৭২ নামের তাবিজ” ব্যবহার করে কাব্বালাকে জনপ্রিয় করেন।
![Philip S. Berg (original name Shraga Feivel Gruberger, Hebrew: שרגא פייבל; August 20, 1927 – September 16, 2013)[1] was an American rabbi and dean of the worldwide Kabbalah Centre organization.](https://qawabat.com/wp-content/uploads/2025/04/Rav_Berg-683x1024.jpg)

বাণিজ্যিকীকরণের সমালোচনা
ঐতিহ্যবাদী ইহুদি সম্প্রদায় কাব্বালা সেন্টারকে “আধ্যাত্মিকতা বিক্রির দোকান” বলে অভিহিত করেন। তারা যুক্তি দেখান, কাব্বালার গূঢ় জ্ঞান কেবলমাত্র তোরাহ অধ্যয়নকারীদের জন্য প্রযোজ্য, পপ সংস্কৃতির অংশ নয় ।[9]
একাডেমিক গবেষণা ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাব্বালা: হার্ভার্ড, ইয়েল, ও হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে কাব্বালার উপর কোর্স চালু হয়েছে।
আন্তঃধর্মীয় প্রভাব: কাব্বালা খ্রিস্টীয় মিস্টিসিজম, সুফিবাদ, ও নিউ এজ আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে বেলে জানা যায়।
৫. কাব্বালা ও সমকালীন সমাজ: শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিকতা
ব্যক্তিগত রূপান্তরের কাব্বালা
কাব্বালিস্টদের (কাব্বালা সাধক) মতে কাব্বালা ব্যক্তিকে আত্ম-উপলব্ধি ও নৈতিক উন্নতির পথ দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, হেসেদ (দয়া) ও গেভুরা (ন্যায়বিচার)-এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে তারা ধারণা করেন।
সামাজিক ন্যায়ের বার্তা
তাদের মতে টিক্কুন ওলাম-এর ধারণা সামাজিক ন্যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ, ও মানবাধিকার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। উদাহরণ: ইসরায়েলের সংগঠন “টিক্কুন” শান্তি ও সহাবস্থানের জন্য কাজ করে বলে তারা দাবি করেন।
প্রযুক্তি যুগে কাব্বালা
সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন কোর্স, ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কাব্বালার শিক্ষা এখন সবার জন্য সহজলভ্য। উদাহরণ: “Kabbalah University” ও “Chabad.org” প্রতিদিন হাজারো ব্যবহারকারীকে সেবা দিয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র
1. Scholem, Jewish Gnosticism, 1960.
2. Kaplan, Sefer Yetzirah, 1997.
3. Idel, Moshe. Kabbalah: New Perspectives. Yale University Press, 1988.
4. Tishby, The Wisdom of the Zohar, 1989.
5. Scholem, Gershom. Major Trends in Jewish Mysticism. Schocken Books, 1941.
6. Matt, Daniel C. The Essential Kabbalah. HarperOne, 1995.
7. Fine, Lawrence. Physician of the Soul, Healer of the Cosmos: Isaac Luria and His Kabbalistic Fellowship. Stanford University Press, 2003.
8. Buber, Tales of the Hasidim, 1947.
9. Myers, Jody. Kabbalah and the Spiritual Quest: The Kabbalah Centre in America. Praeger, 2007.