চাঁদের আলো রং বদলায়
মধ্য শাওয়ালের চাঁদ উঠেছে আকাশে।
সে চাঁদ আলো ছড়িয়েছে গগণ চিরে।
আলো ছড়িয়েছে— রোড লাইট নিভে যাওয়া আই ব্লকের দীর্ঘ রাস্তায়,
গড়িয়ে চলা রিকশার চাকায়,
আনমনে চেয়ে থাকা ছেলেটার মুখে—
যে চেয়ে চেয়ে দেখছে রিকশায় মোবাইল ফোন হাতে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটার মেদ-ময় ব্যস্ততা।
দেখছে চিন্তিত মনে পেডেল মারতে থাকা চালকের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম,
দেখছে পথচারীর হেঁটে যাওয়া।
আবহাওয়াটা মোটেও গরম নয়, মৃদু হাওয়াও বইছে।
সে দেখছে রিকশা চালকের ঘামে ভেজা শরীরে চাঁদের আলো ছড়িয়েছে,
আলো ছড়িয়েছে রিকশায় বসে থাকা যাত্রীর মেদে,
পথচারীর রুক্ষ পায়ে।
আলো ছড়িয়েছে পাশের বারান্দায় খেলনা ট্রাক নিয়ে গড়াগড়ি করে হেসে ওঠা ইমদাদের মুখে,
রমজান এলেই ইফতারি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছুটে আসা রোহানের সাইকেলে।
বাজারের ব্যাগ হাতে বাবা-মা’র সাথে আবেদ চাচার রাস্তা পার হওয়া সে দেখছে।
চাঁদ আলো ছড়িয়েছে সেখানেও,
আলো ছড়িয়েছে পুরো শহরে।
সে দেখছে আর ভাবছে—
এ আলো তো বায়তুল মাকদিসেও ছড়িয়েছে।
আকাশ চিরে আলোর রেখা মাটি ছুঁয়েছে।
আলোর বন্যায় সাগর নুয়েছে।
কিন্তু, এ আলোতে আবেদ চাচা, ইমদাদ, রোহানের মতো কেউ বাবা-মা’র সাথে রাস্তা পার হয় না,
খেলনা নিয়ে হাসাহাসি করে না,
ইফতার নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে না।
এ আলোতে আবেদ চাচার মতো একজন বাবা-মায়ের নিথর দেহে প্রাণ খোঁজে,
হাতে হাত রাখে শেষবারের মতো।
এ আলোতে ইমদাদের মতো এক শিশু তার খেলনা ট্রাক নিয়ে দেয়ালচাপা পড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
সে কাঁদেও না হাসেও না— ওর কান্না আর হাসি দুটির বুঝি উবে গেছে?
ও দেয়ালচাপা পড়ে আছে তাই?
ওর বাবা-মা-বোন, পুরো পরিবার রমজানের রাতে মুখে সেহরির শেষ লোকমা দিতে দিতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তাই?
না!
সে এত কিছু বোঝে না।
সে বোঝে না গণিত, সে বুঝে না পদার্থ।
বোঝে না কিসে সুখ আর কিসে দুঃখ!
তাই সে হাসেও না, কাঁদেও না।
লোকে কি বোঝে না, মৃতরা তো নড়তে-চড়তেও পারে না।
এ আলোতে রোহানের মতো কেউ ইফতার নিয়ে অন্যের বাড়ি হন্যে হয়ে না ছুটে,
ছুটে এক খাবারের গাড়ির পিছনে—
যাতে কিনা ইফতার আছে, পুরো পরিবারের এক সন্ধ্যার ইফতারি।
সে কতখানি খাবার পায়, তা কেউ খোঁজ রাখে না।
দৈনিক ক্যালোরির দুইশো পঞ্চাশই তো তার পুরো হয় না।
কত মাস হয়েছে, তার সাইকেলে উঠা হয় না।
নিজেই ক্ষুধার্ত, পাশের বাড়িতে ইফতারি দেওয়াটাও তার হয় না।
এ আলো উজ্জল নয়, প্রাণবন্ত নয়।
এ আলো মলীন, ম্লান, মায়াহীন।
এ আলোকে সে টেলিভিশনে দেখেছে।
আনমনে চেয়ে থাকা ছেলেটার নিশ্চুপ-ব্রত ভাঙলো তার মায়ের ডাকে।
এ ডাকে সে এতটা চমকিত হলো যেন আহলে বাইতের অধিবাসী কোনো এক মা তার সন্তানকে শেষ বারের মতো ডাকছে।
তার ঘোর এখনো কাটে নি।
চাঁদ কি এভাবেও আলো ছড়ায়?
গায়ে রক্ত মাখে?
ধ্বংসস্তূপে মরীচিকা আঁকে, যেমন সূর্য মরুতে?
আলো কি কালেমার হরফ ছুঁয়ে এলে এমন হয়?
না কি শহীদের রক্তে আলো রং বদলায়!
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো—
মা! আমি ওসামা হবো।
এযুগের সন্ত্রাসের দমনকারী হবো,
হবো আমার ভাইয়ের রক্তের বদলা-লেনেওয়ালা,
হবো আমার মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করেনেওয়ালা।
মা! আমি সালাউদ্দিন হবো।
আমি হবো সেই যে বোঝাবে—
সন্ত্রাস কি কেবল বন্দুকের?
সন্ত্রাস নীরব দৃষ্টির, ক্ষুধার, শিশুর থেমে যাওয়া খেলার।
মা তো কিছুই বোঝে না— কিছুই বলে না।
মা তার এলোচুলে আলো ঝেড়ে ফেলে,
চাঁদের আলোকে নতুন আলোয় মিশিয়ে দিয়ে মা মনে মনে উত্তর দেয়—
বাবু!
যে নেই সে কি করে বুঝবে তোমার সাবলীল কথা?
যে নেই সে কি করেইবা কইবে কথা?
সে বুঝে যায় এ আলো চাঁদের নয়।
বুঝে যায় আলোতেই ওসামা আসে।
সালাউদ্দিন আসে।