২০১৪ সালে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি গভীর পরিবর্তন আসে, যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন কেবল সরকারের প্রশাসনিক গঠনকেই বদলায়নি, বরং ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনে একটি দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার সূচনা করে।
বিজেপির মতাদর্শিক ভিত্তি আরএসএস-এর আদর্শে গড়ে ওঠা, যেখানে একটি হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দীর্ঘদিন ধরে লালিত হয়ে আসছে। ২০১৪ থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই একাদশ বছরের কালপর্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য এবং নিপীড়নের চিত্র ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে।
২০১৪ সালেই মুসলিমবিরোধী বক্তব্য রাজনৈতিক ভাষণের মূলধারায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। মুজাফফরনগর দাঙ্গার পর, বিচার প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায় এবং এনসিআরবির তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার হার প্রায় ২৫% বেড়ে যায় [1]। একই বছরে ‘ঘর ওয়াপসি’ নামক অভিযানে উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম যুবকদের জোর করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তর করার চেষ্টা চালাতে থাকে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা [2]। ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে এমন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আধুনিক ভারতের ইতিহাসে প্রথম নয়, তবে এর পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের নীরব সম্মতি নজিরবিহীন ছিল।
.
২০১৫ সালে ঘটেছিল একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা—দাদরিতে মোহাম্মদ আখলাককে গরুর মাংস রাখার গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায় সেটি গরুর নয়, ছাগলের মাংস ছিল [3]। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গো-রক্ষার নামে সংগঠিত সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
লাভ জিহাদের অপপ্রচারের মাধ্যমে মুসলিম যুবকদের উপর প্রেম এবং বিয়ের (ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী বিয়ে ধর্মীয় বিষয়) মতো ব্যক্তিগত বিষয়েও রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ে। সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো একযোগে মুসলিমদের এক বিকৃত ও হুমকিস্বরূপ চিত্র তৈরি করতে থাকে। ৪২ মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দায়ের করা হয়, পরবর্তীতে মিথ্য প্রমানিত হওয়ায় হয়রানি মূলক সবকটি মামলা খারিজ করা হয় [4]।
.
২০১৬ সালে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হয়। গো-রক্ষা সংক্রান্ত সহিংসতায় অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই জামিন পেয়ে যায় বা খালাস পায়, যার ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়।
গুজরাটের উনা শহরে দলিতদের উপর হামলার বিরুদ্ধে মুসলিম ও দলিতদের যৌথ মিছিলেও পুলিশের দমন-পীড়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। এসময় পুলিশি হামলায় ২ জন নিহত হয় [5]। একই সময়ে হজ ভর্তুকি বাতিল করে মুসলিমদের উপর আর্থিক চাপ বাড়ানো হয়, যেটা তৎকালীন সরকারের ‘আর্থিক সংস্কার’ আখ্যা পেলেও এর প্রভাব মূলত একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের (মুসলিম) উপরই পড়েছিল। ফলে ১৫ লক্ষ মুসলিম হজযাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত [6]।
২০১৭ সালে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারতের মুসলিমদের উপর নির্যাতন একটি নতুন রূপ পায়। রাজস্থানে পেহলু খান (১৬ বছর) নামের এক কিশোরকে গরু পাচারের অভিযোগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয় [7]।
অন্যদিকে কাশ্মীরে প্যালেট গান ব্যবহারের কারণে হাজারেরও বেশি (১,২৫০+ যুবকের চোখের মারাত্মক ক্ষতি হয়) যুবক চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারায় [8]। এসব ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়, কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে একটি সামরিকীকরণ নীতি কার্যকর হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য মুসলিম জনসংখ্যাকে দমন করা।
.
২০১৮ সালে আসামে নাগরিক তালিকা (এনআরসি) কার্যক্রমের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে “বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চূড়ান্ত তালিকায় প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ পড়ে, যার মধ্যে প্রায় ৭০% ছিল মুসলিম [9]। বহু মুসলিম পরিবার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতে বসবাস করলেও উপযুক্ত কাগজপত্র না থাকার কারণে তারা ‘অবৈধ’ ঘোষিত হয়।
এনআরসি বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে ধোপেগড়ায় দাঙ্গা হয় এবং পুলিশের অভিযানে এক হাজারেরও বেশি মুসলিম আটক হন [10]।
.
২০১৯ সালে পাশ হয় অত্যন্ত বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), যেখানে মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার থেকে সরাসরি বঞ্চিত করা হয় [11]। এই আইনটি মুসলিমদের রাষ্ট্র থেকে বিতাড়নের একটি আইনগত কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশজুড়ে মুসলিমরা আন্দোলনে নামে, যার জবাবে পুলিশি বর্বরতা ও কারফিউ জারি করা হয়।
একই বছরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করা হয়, যেটি মূলত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের অধিকার হরণ বলেই আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয় [12]।
.
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সুযোগে মুসলিমদের একটি নৈতিক শত্রুতে পরিণত করা হয়। তাবলীগ জামাতের একটি জমায়েতকে কেন্দ্র করে “করোনা জিহাদ” কথাটি মিডিয়ায় প্রচলিত হয়ে যায় [13]। সুপ্রিম কোর্ট পরবর্তীতে মিডিয়ার এই অপপ্রচারের তীব্র সমালোচনা করে।
এই বছরই ঘটে দিল্লি দাঙ্গা, যেখানে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম। দিল্লি মাইনরিটি কমিশনের রিপোর্টে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং পক্ষপাতিত্ব প্রমাণিত হয় (৩৮ মুসলিম নিহত [14])। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ৫৩টি মৃত্যুর মধ্যে ৪০টি মুসলিম [25]।
.
২০২১ সালে কর্ণাটকে হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, যার ফলে শত শত মুসলিম ছাত্রী পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয় (৬০০+ ছাত্রী বহিষ্কার) [15]। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল পোশাকসংক্রান্ত ছিল না, এটি ছিল মুসলিম নারীদের পরিচয় ও অধিকারের বিরুদ্ধে এক প্রতীকী আঘাত।
পাশাপাশি দিল্লিতে ঐতিহাসিক পাঁচটি মসজিদকে হিন্দু মন্দির হিসেবে দাবি করে মামলা দায়ের করা হয়, যার ফলে ধর্মীয় স্থাপনার স্বত্ব নিয়ে একটি সাংবিধানিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। একই সময়ে মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কটের ডাক দেয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতারা। ফলে মন্দির মেলায় মুসলিমদের নিষিদ্ধ করা হয় [16]।
.
২০২২ সালে সরকার ওয়াকফ বোর্ডের জমি নিয়ে নানারকম হস্তক্ষেপ শুরু করে। উত্তরপ্রদেশে ১২,০০০ একরেরও বেশি জমি “অবৈধ” ঘোষণা করে দখলে নেওয়া হয় [17]। একই বছরে মুসলিম সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়াকে (PFI) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং রাতারাতি দুই হাজারেরও বেশি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয় [18]। এই দমনপীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবাদ জানালেও সরকারের অবস্থান বদলায়নি।
.
২০২৩ সালে কাশ্মীরে আবারও নিরাপত্তাবাহিনীর মাধ্যমে ‘আত্মসমর্পণ নীতি’র নামে গণগ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। পুঞ্চ ও রাজৌরি এলাকায় ৪৫০-এর বেশি মুসলিম যুবক নিখোঁজ হয়, যাদের অনেকে পরে “ফেক এনকাউন্টার” নামক নির্মম কৌশলের শিকার হয় বলে স্থানীয় মিডিয়ায় অভিযোগ ওঠে [19]। ইউএনএইচসিআর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ১,২০০+ কাশ্মীরি যুবক গ্রেপ্তার [26]।
এ বছরই সুপ্রিম কোর্ট ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়, যা একটি সংবিধানিক বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে [20]।
.
২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম ভোটারদের লক্ষ্য করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মহারাষ্ট্রে একটি ম্যানিপুলেটেড ভিডিও ভাইরাল করে দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়, যেখানে মুসলিম যুবকদের গরু জবাইয়ের অভিযোগে দোষারোপ করা হয় [21]।
উত্তরপ্রদেশে ২০০-রও বেশি পোলিং বুথে মুসলিম ভোটারদের বাধা দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশন কার্যত নিশ্চুপ থাকে [22]।
.
২০২৫ সালের শুরুতেই একটি নতুন আতঙ্ক দেখা যায়—“অপারেশন ডিজিটাল শুদ্ধি” নামে দুই লক্ষ মুসলিম নাগরিকের আধার তথ্য ইন্টারনেটে ফাঁস হয়ে যায় [23]। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নাগরিক গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন।
একই সঙ্গে জম্মু অঞ্চলে ৪০০ মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেখানে হিন্দু তীর্থকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয় [24]।
.
এই দীর্ঘ এক দশকের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট হয়, ভারতের মুসলিমরা আজ আর শুধু সামাজিক বৈষম্যের শিকার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটি বিশেষ এজেন্ডার অংশ হিসেবে ধারাবাহিকভাবে নিপীড়নের শিকার। মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪-২০২৫ সময়কালে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৬০টি মুসলিম-বিরোধী সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং ৭৮% ক্ষেত্রে কোনো বিচার হয়নি। এটি নিছক কনস্পিরেসি থিওরি নয়; এটি হল এক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সুগভীর দলিল, যাকে অনেক বিশ্লেষক ‘State-Sponsored Genocide-এর প্রথম ধাপ’ বলেই চিহ্নিত করছেন।
References:
- NCRB, 2014: ২০১৪ সালের অপরাধ পরিসংখ্যান।
- The Wire, 2014: ঘর ওয়াপসি অভিযান।
- The Hindu, 2015: দাদরি লিঞ্চিং তদন্ত।
- India Today Fact Check, 2015: লাভ জিহাদ মামলা।
- Scroll.in, 2016: উনা প্রতিবাদ।
- Economic Times, 2016: হজ ভর্তুকি বাতিল।
- Amnesty, 2017: পেহলু খান হত্যা।
- Al Jazeera, 2017: প্যালেট গান ব্যবহার।
- UNHRC, 2019: NRC প্রক্রিয়ার নিন্দা।
- The Quint, 2018: ধোপেগড়া হামলা।
- BBC, 2019: CAA আইনের বিশ্লেষণ।
- The Guardian, 2019: আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল।
- Supreme Court Verdict, 2021: তাবলীগ জামাত রায়।
- Delhi Minorities Commission, 2020: দিল্লি দাঙ্গা প্রতিবেদন।
- Al Jazeera, 2021: কর্ণাটক হিজাব নিষেধ।
- NDTV, 2021: মুসলিম ব্যবসায়ী বয়কট।
- The Hindu, 2022: ওয়াকফ জমি দখল।
- HRW, 2022: PFI নিষিদ্ধকরণ।
- BBC, 2023: পুঞ্চ অভিযান।
- Bar & Bench, 2023: ধারা ৩৭০ রায়।
- AltNews, 2024: ফেক ভিডিও যাচাই।
- The Wire, 2024: উত্তরপ্রদেশ ভোটার দমন।
- Indian Express, 2025: আধার ডাটা লিক।
- Al Jazeera, 2025: জম্মু উচ্ছেদ।
- HRW, 2020: দিল্লি দাঙ্গা প্রতিবেদন।
- UNHRC, 2023: কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন।