বই রিভিউ: “The Purpose of Life – Jeffrey Lang’s Exploration of Faith”
লিখেছেন: জেফ্রি ল্যাং
(বাংলা অনুবাদ ও পর্যালোচনা)
ভূমিকা
জেফ্রি ল্যাং-এর “The Purpose of Life” ইসলামী দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও মানব অস্তিত্বের উদ্দেশ্য নিয়ে একটি গভীর চিন্তার খোরাক। আমেরিকান গণিতবিদ ল্যাং, যিনি নাস্তিকতা থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, এই বইতে যুক্তি, বিজ্ঞান ও কুরআনের আলোকে জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন। বইটি বিশ্বজুড়ে মুসলিম ও অমুসলিম পাঠকদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য বইটির একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা এখানে উপস্থাপন করা হলো।
অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা
১ম অধ্যায়: “অস্তিত্বের প্রশ্ন ও নাস্তিকতার যাত্রা”
ল্যাং তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করেছেন—কীভাবে এক আমেরিকান যুবক হিসাবে নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং পরবর্তীতে ইসলামের সন্ধান পেলেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন: “জীবনের অর্থ কী? আমরা কেন এখানে?” এই অধ্যায়ে তিনি পাশ্চাত্য দর্শনের সীমাবদ্ধতা ও বস্তুবাদী চিন্তাধারার ফাঁকগুলো তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞান ও যুক্তিই কেবল উত্তর দিতে পারে না; প্রয়োজন আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি।
২য় অধ্যায়: “ঈশ্বরের অস্তিত্ব: যুক্তি ও কুরআনের আলোকে”
এই অধ্যায়ে লেখক ইসলামের ধারণা “তাওহিদ” (একত্ববাদ) কে যুক্তি ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মহাবিশ্বের জটিলতা, মানবদেহের নকশা এবং নৈতিকতার উৎসকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। কুরআনের আয়াত (যেমন, সূরা রূম, সূরা ফুসসিলাত) উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন কীভাবে কুরআন প্রাকৃতিক নিয়ম ও মানবিক বিবেকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৩য় অধ্যায়: “মানুষের উদ্দেশ্য: ইবাদত ও খিলাফত”
ল্যাং এখানে কুরআনের বক্তব্য “আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি” (সূরা যারিয়াত ৫৬)-এর গভীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, “ইবাদত” কেবল নামাজ-রোজা নয়, বরং ঈশ্বরের সৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ন্যায় ও দায়িত্বশীল জীবনযাপন। “খিলাফত” (প্রতিনিধিত্ব) ধারণার মাধ্যমে তিনি ব্যাখ্যা করেন, মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে পরিবেশ, সমাজ ও নিজের আত্মার দায়িত্ব পালন করবে।
৪র্থ অধ্যায়: “স্বাধীন ইচ্ছা ও দায়বদ্ধতা”
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও ভাগ্যের সম্পর্ক ইসলামে একটি জটিল বিষয়। ল্যাং এখানে কুরআন ও হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে ব্যালেন্সড আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, আল্লাহ মানুষকে পছন্দের স্বাধীনতা দিয়েছেন, কিন্তু প্রতিটি পছন্দের পরিণামের দায়িত্বও নিতে হবে। তিনি “তাকদির” (ভাগ্য) ধারণাকে অন্ধ বিশ্বাস না দেখে বরং আল্লাহর জ্ঞানের পরিপূর্ণতা হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।
৫ম অধ্যায়: “কষ্ট ও পরীক্ষা: জীবনের অর্থ খোঁজা”
এই অধ্যায়ে লেখক মানব জীবনের দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোকের রহস্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরআনের সূরা বাকারা (১৫৫-১৫৭ নং আয়াত) উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরীক্ষাই ঈমানের শক্তি বাড়ায় এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটায়। তাঁর মতে, কষ্টের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আল্লাহর রহমত ও শিক্ষা—যেমন একটি শিশু হাঁটতে শেখার আগে বারবার পড়ে যায়।
৬ষ্ঠ অধ্যায়: “আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক”
শেষ অধ্যায়ে ল্যাং ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার পদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন। তিনি সালাত, জিকির ও কুরআন অধ্যয়নকে “আত্মার পুষ্টি” হিসাবে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, আল্লাহর স্মরণই মানব হৃদয়ের অস্থিরতা দূর করে এবং জীবনের লক্ষ্য স্পষ্ট করে।
লেখকের চিন্তার সারসংক্ষেপ
জেফ্রি ল্যাং এই বইয়ে দেখিয়েছেন যে ইসলাম কোনো শুষ্ক নিয়মের ধর্ম নয়, বরং এটি যুক্তি, বিজ্ঞান ও হৃদয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাঁর মূল বক্তব্য হলো:
- জীবনের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্ধান ও তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা।
- কষ্ট ও আনন্দ উভয়ই এই যাত্রার অংশ, যা মানুষকে পরিপক্ব করে।
- স্বাধীন ইচ্ছা মানুষের মহান দান, কিন্তু এর সঠিক ব্যবহারই তাকে সফল করে।
ল্যাং-এর লেখার শক্তি হলো যুক্তি ও আবেগের সমন্বয়। তিনি পাশ্চাত্য পাঠকদের ইসলামের ভুল ধারণা দূর করতে চেয়েছেন, আবার মুসলিম পাঠকদের বিশ্বাসকে গভীর করতে সহায়তা করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত গল্প (যেমন কুরআন পড়ার সময় কান্না) বইটিকে বিশ্বাসযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে।
সমালোচনা ও পাঠকদের জন্য পরামর্শ
বইটির ভাষা সরল ও প্রাঞ্জল, তবে কিছু দার্শনিক তত্ত্ব (যেমন তাকদির) নতুন পাঠকের জন্য জটিল মনে হতে পারে। তবুও ল্যাং-এর যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও কুরআনের উদাহরণ বিষয়গুলো স্পষ্ট করে। বইটি বিশেষভাবে উপযোগী:
- যারা নাস্তিকতা/অজ্ঞেয়বাদ থেকে ইসলামের দিকে আসছেন।
- যারা ইসলামী বিশ্বাসকে যুক্তির আলোকে বুঝতে চান।
- তরুণ প্রজন্ম যারা আধ্যাত্মিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
উপসংহার
“The Purpose of Life” শুধু একটি ধর্মীয় বই নয়, বরং একটি দার্শনিক গাইড যা জীবনের গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়। জেফ্রি ল্যাং প্রমাণ করেছেন যে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা পরস্পরবিরোধী নয়—বরং তারা একই সত্যের দুটি দিক। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য এই বই ইসলামকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেবে, বিশেষ করে যারা যুক্তি ও হৃদয়ের সমন্বয়ে বিশ্বাসী।